প্রশ্ন-০১ : মানহাজ কী? সালাফী মানহাজ কেন গুরুত্বপূর্ণ? | ইসলামী আকিদা ও আমলের সঠিক পদ্ধতি - SalafiArchive

সালাফী মানহাজ কী এবং কেন প্রতিটি মুসলিমের জন্য এটি অনুসরণ করা জরুরি? জানুন কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামী আকিদা ও আমলের সঠিক পদ্ধতি।
Source: SalafiArchive.com
সালাফী মানহাজের গুরুত্ব

প্রশ্ন (১) : মানহাজ কাকে বলে? মানহাজ কোন কোন ক্ষেত্রে প্রযোজ্য?

জনৈক আলিম বলেন, প্রত্যেক মুসলিমের উপর 'সালাফী মানহাজ' অনুসরণ করা আবশ্যক। প্রশ্ন হল- 'সালাফী মানহাজ' বলতে কী বুঝায়?

উত্তর :

'মানহাজ' (مَنْهَج) অর্থ পথ, পন্থা, পদ্ধতি, প্রশস্ত রাস্তা, প্রোগ্রাম, কার্যক্রম, কারিকুলাম ইত্যাদি (মুসলিম হা/২৪৮৪; ইবনে মাজাহ হা/৩৯২০; মায়েদাহ ৪৮; আহমাদ হা/১৮৪৩০)। একজন মুসলিমের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে ইসলামী আদর্শ, রীতি-নীতি বা পদ্ধতি অনুসরণ করে চলে, তাকেই 'মানহাজ' বলে। আর একজন মুসলিম ব্যক্তির জীবনের সর্বক্ষেত্রেই যথা—

  • আক্বীদা-বিশ্বাস,
  • ইবাদত-বন্দেগী,
  • চাল-চলন,
  • আচার-ব্যবহার,
  • লেনদেন

সবকিছুতেই সালাফী মানহাজ প্রযোজ্য (ড. ছালেহ ইবনু ফাওযান, আল-আজওয়াবাতুল মুফীদাহ 'আন আসইলাতিল মানাহিজিল জাদীদাহ, প্রশ্ন নং-৪৪)।

'সালাফী মানহাজ'-এর পরিচয় :

'সালাফ' শব্দের আভিধানিক অর্থ পূর্ববর্তী, পূর্বসূরি, অগ্রবর্তী, পূর্বপুরুষ ইত্যাদি (সূরা আয-যুখরুফ : ৫৬; সূরা আন-নিসা : ২৩; ছহীহ বুখারী হা/৬২৮৬)। পারিভাষিক অর্থে, ছাহাবী, তাবিঈ ও তাবি‘ তাবিঈগণকে ‘সালাফ’ বলা হয়। আর যারা নিষ্ঠার সাথে তাঁদের অনুসরণ করেন, তাঁদের পথ ও পদ্ধতির উপর অটল থাকেন, তাঁদেরকে ‘সালাফী’ বলা হয়। যেমন রাসুলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

"خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِيْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ"
অর্থ: 'আমার যুগের লোকেরাই সর্বোত্তম ব্যক্তি (ছাহাবীরাগণ)। অতঃপর যারা তাঁদের নিকটবর্তী (তাবিঈগণ)। অতঃপর যারা তাঁদের নিকটবর্তী (তাবি' তাবিঈগণ).....' (ছহীহ বুখারী, হা/২৬৫২, ৩৬৫১, ৬৪২৯, ৬৬৫৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৩৩)।

এ প্রসঙ্গে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, "ইমাম আবুল মুযাফফার সাম'আনী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, 'আমরা সুন্নাতের অনুসরণ করতে আদিষ্ট হয়েছি এবং বিদ'আত হতে আমাদেরকে নিষেধ ও তিরস্কার করা হয়েছে। সুতরাং আহলুস সুন্নাহর প্রতীক হল, সালাফে ছালিহীনের অনুসরণ করা এবং প্রত্যেক নব উদ্ভূত ও বিদ'আতকে বর্জন করা'" (ছাওনুল মানত্বিক, পৃ. ১৫৮)।

সালাফী মানহাজের সংজ্ঞা :

অতএব ‘সালাফী মানহাজ’ বলতে পূর্বসূরীদের তরীকাকে বুঝায়। অর্থাৎ ছাহাবী ও তাবিঈগণ যে পথ, পন্থা, পদ্ধতি ও রীতি-নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, তাকেই ‘সালাফী মানহাজ’ বলা হয়। আল্লামা সাফ্ফারীনী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘সালাফদের মানহাজ বলতে উদ্দেশ্য হল- যে আদর্শের উপর ছাহাবায়ে কিরামগণ, তাবিঈগণ ও তাবি‘ তাবিঈগণ ছিলেন এবং দ্বীনের সেই ইমামগণ, যাদের ইমাম হওয়ার ব্যাপারে সাক্ষী প্রদান করা হয়েছে, দ্বীনে তাঁদের বিশাল মর্যাদা বিদিত হয়েছে এবং তাঁদের বাণীকে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল যুগের মানুষই সাদরে গ্রহণ করেছে। তারা নয়, যাদেরকে বিদ‘আতী আখ্যায়িত করা হয়েছে অথবা যারা অসন্তোষজনক উপাধি নিয়ে প্রসিদ্ধ হয়েছে। যেমন, খাওয়ারিজ, রাওয়াফিয, ক্বাদারিয়্যাহ, মুরজিয়্যাহ, জাবারিয়্যাহ, জাহমিয়্যাহ, মু‘তাযিলাহ, কারামিয়্যাহ প্রভৃতি সম্প্রদায়’ (লাওয়ামিঊল আনওয়ার, ১ম খণ্ড, পৃ. ২০)।

আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকেই শ্রেষ্ঠ উম্মত বলেছেন (আলে ইমরান ১১০)। তাই সর্বক্ষেত্রে তাঁদের অনুসরণ করলে আমরা হেদায়াত পাব, অন্যথা পরিণাম জাহান্নাম (বাক্বারাহ ১৩৭; নিসা ১১৫)। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে ছিরাতে মুস্তাক্বীম চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন আমরা বলি, اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ (৬) صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ ‘আপনি আমাদেরকে সোজা-সরল পথে পরিচালিত করুন, তাঁদের পথে- যাদের প্রতি আপনি অনুগ্রহ করেছেন’ (সূরা ফাতিহা ৬-৭)। আল্লাহ যাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, তাঁরা হলেন, নবীগণ, ছিদ্দীক্বগণ, শহীদগণ এবং সৎ বান্দাগণ। আর তাদের সান্নিধ্য কতই না উত্তম। এই অনুগ্রহ সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে (সূরা নিসা ৬৯-৭০)। তাই শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, أَمَرَ بِسُؤَالِهِ الْهِدَايَةَ إلَى صِرَاطِهِمْ ‘আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের পথের আলোকেই হেদায়াত চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন’ (ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ ২০/৫০০ পৃঃ)।

মাযহাব ও সালাফী মানহাজ :

হানাফি, শাফেয়ী, মালিকি, হাম্বলি মাযহাব অবশ্যই আহলুস সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। এই মাযহাবের ইমামগণ সকলেই সালাফ তথা রাসুল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবী এবং তাদের অনুসারী ছিলেন। এই অর্থে তারা সকলেই সালাফি ছিলেন। এই মাজহাবগুলোর মাঝে আকীদাগতভাবে উল্লেখযোগ্য মতবিরোধ নাই। তবে শাখা গত মাসাআলা মাসায়েলে প্রচুর দ্বিমত আছে। এই মতবিরোধগুলো সৃষ্টি হয়েছে দলিল জানা ও বুঝাকে কেন্দ্র করে এবং হাদিস সহিহ-যঈফগত বিষয়ে দ্বিমত থাকার কারণে। কিন্তু ইন শা আল্লহ এতে কোনও ক্ষতি নাই।

সকল মুসলিমের জন্য করণীয় হল, যখনই কোন সহিহ হাদিস পাওয়া যাবে এবং মাজহাবের কোন মাসআলায় অন্য কোন মত দলিলের মাধ্যমে অধিক শক্তিশালী প্রমাণিত হবে তখন তা গ্রহণ করা। সকল ইমাম জাতিকে এই নির্দেশই গিয়ে গেছে। এটাই সালাফীদের নীতি। সালাফিগণ সকল মাযহাবের ইমামকে সম্মান করে, তাদের নাম উচ্চারণের সাথে সাথে তাদের জন্য দোয়া করে কিন্তু তাদের কোন একজনকে সবকিছুর ক্ষেত্রে নিঃশর্ত ভাবে অনুসরণ করাকে সঠিক মনে করে না। কারণ তারা সকলেই মানুষ ছিলেন। আর কোনো মানুষই সর্ব জ্ঞানী নয়। একমাত্র রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া শরীয়তের ক্ষেত্রে কেউ ভুলত্রুটির উর্ধ্বে নন। ‌ সুতরাং তাদের দলিল সম্মত কথা গ্রহণযোগ্য এবং দলিল বহির্ভূত কথা প্রত্যাখান যোগ্য।

কোন একজন ইমামের পক্ষে মাযহাবি গোঁড়ামি করা জায়েজ নাই। এই গোঁড়ামি মুসলিম জাতির অধ:পতন ও বিশৃঙ্খলার অন্যতম কারণ। আল্লহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমিন।

প্রশ্নকারী : আল-মামুন, কানসাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।

সূত্র : মাসিক আল-ইখলাছ, সেপ্টেম্বর ২০২১

উত্তর প্রদানে : শায়খ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

Post a Comment

আপনার কমেন্ট রিভিউ করে দেখা হবে! প্রয়োজনে SalafiArchive কর্তৃপক্ষ আপনার কমেন্ট রিমুভ করার অধিকার রাখে।

Join the conversation

Disqus shortname is missing. Consider reporting about this message to the admin of this blog. It seems you are the admin of this blog, add disqus shortname through Theme HTML editor to enable Disqus comments.

Join the conversation